সোম. এপ্রি ২৯, ২০২৪
উত্তাল সংবাদ ডেস্ক।

দক্ষিণের ডায়েরি: ভোলা নারিকেল বাগান ঘুরিয়ে দেখানোসহ কচ্ছপিয়া ঘাট থেকে চরকুকরী মুকরী আপডাউন স্পিডবোড ঠিক করা হয় সাড়ে তিন হাজার টাকায়।

ঘাটে বোট ছিল ৫/৬টি। সাধারণ ইঞ্জিনের নেৌকাও আছে।
খালের ভেতর দিয়ে প্রবেশ করার সময় দুপাশের কেওড়া বন দেখতে বেশ লাগে। আস্তে আস্তে খালের প্রশস্ততা বাড়ে। দেখতে নদীর মতো লাগে। এ জায়গাটা সুন্দরবনের মতো। দুপাশে গোলপাতা ছাড়াও শ্বাসমূলওয়ালা নানারকম গাছগাছালি। কখনো একটি দুটি ঘর। এগিয়ে চলে বোট। সামনে দিগন্ত বিস্তারী চর। এদিকটায় গাছপালা নেই। নদীর পাড়ে চরের ঢালে চাষ করা হয়েছে ধান। পটুয়াখালীর ছেলে মনিরুল শ্বাসমূলওয়ালা ম্যানগ্রোভ গাছ চেনেন না বলে খোঁটা দিলেন নুরুল আমিন বেশ কয়েকবার। এবার বোনা আমন ধানের জমি দেখিয়ে নুরুল আমিন জানতে চান, – এগুলো কী ধান? – বোরো ধান। – এই বার ঠিক বলেছেন! চরে চড়ে বেড়ায় গরু, মোষ ও ভেড়া। খালে একবার একপাল মোষ পড়ল আমাদের স্পিডবোটের সামনে। নতুন জেগে ওঠা চরে লাগানো হয়েছে গাছের চারা। এগুলো বড় হবে শিগগিরই। বড় নদীর মোহনায় বাম পাশে বনবিভাগের ইকোপার্ক। জীববৈচিত্র সংরক্ষণের উদ্যোগ। ডানপাশের চরে সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার। ইকোপার্কে নামতে হলো। ভেতরে অল্প একটু ওয়াকওয়ে। পাখির কলকাকলি শোনা গেল। নুরুল আমিন বললেন, এখানে নাকি হরিণ আছে। মনিরুল বললেন, হরিণ থাকলে তো বাঘ থাকতে হয়। বাঘ না থাকলে মানুষে হরিণ ধরে নিয়ে যাবে। জঙ্গলের ভেতর বেশ গরম। দ্রুত বেরিয়ে আসি। গাছ দেখার সময় কই? আবার স্পিডবোটে উঠি। – নারকেল বাগান নিয়ে যান। -ওখানেই তো নারকেল বাগান। দেখে আসেননি? – নারকেল বাগান দেখানোসহ তো আপনার সঙ্গে চুক্তি। – নারকেল বাগানে আলাদা ঘাট নেই। নদী থেকেই দেখতে হবে। আমিনের স্পষ্ট প্রতিবাদে সেদিকেই স্পিডবোট হাঁকায় মাঝি। নারকেল বাগান কোথায়! ৫/৬টি নারকেল গাছের আগা চোখে পড়ল। মোহনা পার হয়ে একটি চরের দক্ষিণভাগ দেখাতে দেখাতে বোট এগিয়ে চলল। বাতাসের ঝাপটায় বনের পূর্ব ও দক্ষিণ পাশের বাইরের দিকটায় গাছগুলোকে মনে হলো অঙ্গার। বঙ্গোপসাগর থেকে আসা বাত্যা প্রথমেই আঘাত হানে এসব জায়গায়। প্রাকৃতিক দুযোগের ক্ষেত্রে সুন্দরবন তাই দেশের জন্য ঢাল হিসেবে কাজ করে। প্রশস্ত মেঘনা ও সাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশি পেছনে ফেলে পৌছে গেলাম চরকুকরী মুকরী ঘাটে। একপাশে নোঙর করা আছে বড় একটি লঞ্চ। নাজিরপুর রুটে যাতায়াত করে। ড্যাম তৈরি করে চরের ভেতরে ঢোকার খাল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অন্যথায় বোট নিয়ে বাজারে পৌছে যাওয়া যেত। ঘাট থেকে একটি অটো নিই। লক্ষ্য করি খালের উপর ব্রিজ তৈরি করা হয়েছে। চরের ভেতরে একেবারেই গ্রামীণ জনপদ। দেশের আর দশটা জায়গার মতো। বাজারের কাছাকাছি বন বিভাগ তৈরি করেছে বড়সড় এক রেস্ট হাউস। স্থানীয় সাংসদ আগের বার বন উপমন্ত্রী ছিলেন। বাইরে থেকে আসা লোকজন আস্ত মাছ দিয়ে বারবিকিউ এর আয়োজন করছে। মনিরুল ছবি তুললেন আগ্রহভরে। এরপর চা খাব বলে বাজারের দিকে রওনা হই। বাজার ২০০ গজের মধ্যেই। এদিকটায় একটি খালে দেখা গেল বেশ কয়েকটি মালবোঝাই বড় নৌকা। বোঝা গেল, জলপথে চরে ঢোকার ভিন্ন রাস্তাও রয়েছে। এক দোকানে ডাব দেখে দাম জিজ্ঞেস করলাম। ১০০ টাকা পিস! নুরুল আমিন ফোন করে তার বাড়িতে ডাবের অর্ডার দিয়ে রাখলেন। গাছ থেকে যে কয়টা পাড়া যায় সবকটি যেন পাড়িয়ে রাখে। স্যারদের খাওয়াবেন। আমিনের বাড়ি বোরহানউদ্দিনে। রাস্তার পাশেই। তিনি তার স্কুল দেখিয়েছিলেন রাস্তার পাশে। ১৯৮০ সালে এই স্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন সাবেক সচিব মেজবাহ উদ্দিন স্যারের সাথে। চর কুকরী মুকরী বাজারটি তিনগলির। বাজারের অবকাঠামো পাকা। একপাশে কুকরী মুকরী মাধ্যমিক বিদ্যালয়। স্কুলের গেট সংলগ্ন দোকানটি ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার। দোকানি অল্পবয়সের তরুণ। কফি বানিয়েছে চমৎকার। ১৫ টাকা মগের কফি খেতে খেতে তার দোকানের বৃত্তান্ত নিলাম। ৬ মাস আগে চালু করেছে। সে স্কুলেই চাকরি করে। আগে ঢাকায় চাকরি করত। স্কুলে পড়ালেখা কেমন হয় জানতে চাইলে বলল, ৫২ জন পরীক্ষার্থীর সবাই এসএসসি পাস করেছে। পাশের মাদ্রাসাটিরও নাকি রেজাল্ট ভালো হয়। বাজারের অবকাঠামো মন্দ নয়। ফেরার পথে ঘাটে আমাদের বোটটি চোখে পড়ছিল না। হালকা বৃষ্টি শুরু হয়েছে ততক্ষণে। ঘাটের চায়ের দোকানে বসি। এখানে প্রৌঢ় লোকেরা বসে আড্ডা দিচ্ছিল। তাদের কাছে জানতে চাইলাম, ঝড়ের প্রকোপ এখানে কেমন?একজন জানালেন, ঝড় তো প্রতিবছরই হয়। -ঝড়ের সময় লোকজন কি সাইক্লোন শেল্টার সেন্টারে আশ্রয় নেয়? -বাড়িঘর ছেড়ে লোকজন যেতে চায় না। – ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি কেমন হয় জানতে চাইলে প্রৌঢ়দের একজন বললেন, সত্তরের বন্যার (জলোচ্ছ্বাসকে ওরা বন্যা বলে) সময় মা আমাকে একটি মান্দার গাছের সঙ্গে বেঁধে রেখেছিলেন। ফুফু আমার কাছে ছিল। ফুফু পানিতে ভেসে গিয়ে মারা যান। গোটা চরে একটিমাত্র ঘর টিকে ছিল। মানুষ মরেছিল শয়ে শয়ে। ফেরার পথে আমিনের বাড়িতে যেতে হয়। পুকুর পাড়ে মসজিদ। পাশে তার বাবা মায়ের কবর। বৃষ্টির মধ্যে কবর জিয়ারত করেন। আমরা মোনাজাতে সামিল হই বৃষ্টির মধ্যেই। জানার ইচ্ছে ছিল আমিনের সাকসেসের গোপন রহস্য। বড় আমল না করলে মানুষ বড় হয় না। নূরুল আমিন নিজের সংসারে ভাইয়ের মেয়েকে সন্তানের স্নেহে বড় করছেন। নিজের সন্তানেরা সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এরই মধ্যে। পুকুর পাড়ে তার লাগানো গাছগুলো দেখান টর্চ জ্বেলে। গাড়িতে ডাবের ছড়া তুলে আবার রওনা হই শহরের উদ্দেশ্যে। নূরুল আমিন আগেই বলেছিলেন আমাদের নাজিউর রহমান মঞ্জুর বাড়ি দেখাবেন। রাত নয়টার পর কি এরকম জায়গায় ঢোকা যায়।! আমিনের চোটপাট আছে। সিকিউরিটিকে গেট খুলতে বাধ্য করেন। নিয়ে দেখালেন পুকুর পাড়ে পিতলের ( অথবা তামার) ডেগ। আজমীর শরিফ থেকে এনেছিলেন নাজিউর রহমান। যতটুকু মনে পড়ে পাতিলের ঢাকনার ডায়ামিটার আমার হাতে সাড়ে ছয় হাত। খাবার সংগ্রহের জন্য পাতিলের ভেতর নাকি মই দিয়ে নামতে হয়। এ পাতিলে আড়াই হাজার লোকের জন্য খিচুড়ি রান্না করা যায়।##
লেখক: মো: ইয়াকুব আলী,পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ),গণযোগাযোগ অধিদপ্তর,ঢাকা

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *