বৃহঃ. মে ২, ২০২৪

রাতের খাবার পথের ধারের এক রেস্টুরেন্টে সেরে নিই রংপুর পার হওয়ার পর,

উত্তাল সংবাদ ডেস্ক।

উত্তরের খেপ: কুড়িগ্রাম ঠাকুরগাঁও হতে সৈয়দপুর হয়ে সড়কপথে কুড়িগ্রাম পৌছলাম রাত ১০ টার পর। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল খুব। সারাদিন নাকি কুড়িগ্রাম শহরে বৃষ্টি হয়েছে। রাতের খাবার পথের ধারের এক রেস্টুরেন্টে সেরে নিই রংপুর পার হওয়ার পর। রেস্টুরেন্টে একটি সাইনবোর্ডে লেখা: ‘এ রেস্টুরেন্টের খাবার সম্পর্কে কোনো অভিযোগ থাকেলে ফোন করুন ০১….. নম্বরে’। বোঝা গেল মালিক ব্যবসা ছাড়াও সেবার ব্রত নিয়ে রেস্টুরেন্টটি পরিচালনা করছেন। লক্ষ্য করলাম লোকজন বেশ খাচ্ছে এখানে। কুড়িগ্রাম একটি অনগ্রসর জেলা। বাংলাদেশের ম্যাপের উত্তর পূর্বে এর অবস্থান। যেতে যেতে আমাদের অফিসার শাজাহান আলী ব্রিফ করছিলেন: উত্তরের ভুরুঙ্গামারি উপজেলার সাথে ভারতের তিনটি রাজ্যের সীমান্ত: পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও মেঘালয়। সার্কিট হাউসে পৌঁছে পেলাম জেলা প্রশাসনের একটি প্রকাশনা : Land of Alluvial Beauty. কনটেন্ট দুর্বল হলেও অনেক যত্ন করে প্রকাশনাটি তৈরি করা হয়েছে। ঘুমানোর আগে বইটি দেখে কুড়িগ্রাম সম্পর্কে ভালো ধারণা পাওয়া গেল। জেলাটি নদীবিধৌত। নদীর সংখ্যা ১৬টি। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা ছাড়াও আছে বাহারি নামের দুধকমর, ফুলকমর, সোনাভরী, নীলকমল, জিঞ্জিরাম, বোয়ালমারি, ধরণী ইত্যাদি। লেখক সৈয়দ শামসুল হকের বাল্যকাল কেটেছে কুড়িগ্রামে। তার পিতা একজন হোমিও চিকিৎসক ছিলেন। তিনি নাকি এসেছিলেন ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে। সৈয়দ হককে নিয়ে কুড়িগ্রামবাসীর গর্বের অন্ত নেই। তিনি ‘জলেশ্বরী’র প্রান্তজনকে নিয়ে লিখেছেন বিস্তর। এতই লিখেছেন যে তিনি ‘সব্যসাচী লেখক’ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছেন প্রাকৃতজনের কাছে। একজন প্রান্তজন হয়েও ‘জাগো বাহে কোনঠে সবায়’ ছাড়া তার এক পংক্তিও আমার মুখস্ত নেই। এ আমার অযোগ্যতা। বাংলা চলচ্চিত্রেও হকের অবদান অসীম। তিনি সংলাপ লিখেছেন অনেক ছবির। ছায়াছবির গানও লিখেছেন। তারুণ্যে তিনি বোম্বাই গিয়েছিলেন সিনেমার কাজ শিখতে। এক সাক্ষাৎকারে সৈয়দ হক বলেছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই তিনি একজন পরিচালকের পদসেবা করে (পা টিপে) কাজ শিখতে চেষ্টা করেছিলেন। কুড়িগ্রামবাসী সৈয়দ হককে সমাহিত করেছে কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ চত্বরে। কুড়িগ্রামে নাগেশ্বরী নামের উপজেলা আছে। জলেশ্বরীর কোনো অস্তিত্ব না থাকলেও (বগুড়া শহরে জলেশ্বরি তলা নামে একটি জায়গা আছে ) কুড়িগ্রামই সৈয়দ হকের জলেশ্বরী- জলের বাংলাদেশ। কবিরা কত কিছুই না পারেন! কবি বাল্মিকী যেমনটা লিখেছেন: অযোধ্যা নাকি রামের জন্মভূমি। তাহলে কুড়িগ্রাম তো জলেশ্বরী হবেই। তেমনি আরেক আখ্যান: চিলমারী বন্দর। চিলমারী বন্দর দেখাবে বলে শাহজাহান রওনা হয়। সঙ্গে সহকর্মী রাকিব ও হুমায়ুন। বৃষ্টির ভেতর গ্রামীণ জনপদ দেখতে বেশ লাগে। বেশির ভাগ ভূমি নিচু। বোঝা যায় সামান্য বন্যায় এসব এলাকা তলিয়ে যায়। নদীগুলো তাই কুড়িগ্রামের দুঃখ। সারাদিন বৃষ্টির কারণে হেঁটে কুড়িগ্রাম শহরটি দেখা হলো না। হাটতে না পারলে কোন জায়গা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়? ৩০ কিলো দূরের চিলমারি বন্দরে যখন পৌছলাম তখন বৃষ্টি জোরদার হয়েছে। কীসের বন্দর? ব্রহ্মপুত্র নদীতে ছোট একটি ঘাট।একটি গাছে সাঁটা সাইনবোর্ড: ‘চিলমারী নদীবন্দর’। পল্টুনসহ ছোট কয়েকটি জলযান আছে। রৌমারির সাথে নাকি সম্প্রতি ফেরি চালু হয়েছে। ঘন্টা তিনেক লাগে রৌমারি পৌছতে। শাহজাহান জানাল, কুড়িগ্রামে চরের সংখ্যা ৪৫০টির বেশি। এসব মানুষের জীবন অনেক কষ্টের। চরগুলো আবার স্থায়ী নয়। বর্ষায় নদীর প্রবল স্রোতে চর ভাঙে। আবার নতুন চর গজায়। এরকমই এখানকার নদীর খেলা। ভাওয়াইয়া গানের কারণে বিখ্যাত হয়ে আছে চিলমারী বন্দর : ‘ও কি গাড়িয়াল ভাই, কত রব আমি পন্থের দিকে চাইয়া রে…/ যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়/ নারীর মন মোর ছুইরা রয় রে…/ ও কি গাড়িয়াল ভাই/ হাঁকাও গাড়ি তুই চিলমারীর বন্দর এ রে…’। কোনো এককালে, যখন পাটের ব্যবসা ছিল, পাট বোঝাই করে চালান দেওয়ার উদ্দেশ্যে মোষের গাড়ির গাড়োয়ানরা রওনা হতো চিলমারীর উদ্দেশ্যে। তখনকার দিনে পূর্ববঙ্গ থেকে ধান-পাটের বড় নৌকা যেত কলকাতা বা আসামের উদ্দেশ্যে। এখন তো সে রকম রাস্তার উপযোগী ভূখন্ডও চোখে পড়ে না। নেই গরু বা মোষের গাড়ি। তবে ঘোড়ার টানা গাড়ি চোখে পড়লো উলিপুরগামী সড়কে। কুড়িগ্রামের চরের বাহন নাকি ঘোড়া। শাহজাহান জানালেন, চিলমারী বন্দরের সমৃদ্ধি যা দেখে আপ্লুত হয়েছিলেন ভাওয়াইয়া গানের সেই গীতিকার তা হয়তো ১৮৯৭ এর ভূমিকম্পের আগের। ব্রহ্মপূত্রের গতিপথ পরিবর্তনের আগের কথা। হবে হয়তো। দুর্ভিক্ষের প্রতীক (ছবিটি নিয়ে বিতর্ক আছে) বাসন্তীর বাড়ি চিলমারী বন্দরের পাশে। কুড়িগ্রামে এখন আর মঙ্গা নাই। ছেলে-মেয়েরাও পড়াশোনা করছে। উলিপুরে এক মিষ্টির দোকানে কুড়িগ্রামের বিখ্যাত ক্ষীরমোহন মিষ্টি খাওয়াতে বসে শাজাহান জানালেন, প্রতি বছর বিসিএস পরীক্ষায় ৩৫ -৪০ জন কোয়ালিফাই করে। তবে মনটা খারাপ হয়ে গেল বন্ধ হয়ে যাওয়া কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলস এর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময়। এখন নাকি এখানে চালু হবে বিশ্ববিদ্যালয়। শেষ করার আগে জানিয়ে রাখি : কুড়িগ্রামের ব্র্যান্ডিং নাম হচ্ছে- ‘ভাওয়াইয়া গানের ধাম/নদ- নদীময় কুড়িগ্রাম।’ (সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল, ঢাকা থেকে )

লেখক: মো: ইয়াকুব আলী,পরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ),গণযোগাযোগ অধিদপ্তর,ঢাকা#

tot

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *