বৃহঃ. এপ্রি ২৫, ২০২৪

কৃষিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া, বিলুপ্ত গরুর লাঙ্গল,

আগামী প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাচীন উপকরণ লাঙ্গল,

নেত্রকোণা হাওরপাড়ের অধিকাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন কৃষিকাজে।  জেলার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ফসলি জমিতে কৃষিকাজে ব্যবহৃত প্রাচীন উপকরণ লাঙ্গল, জোয়াল, মই এখন প্রযুক্তির ভিড়ে প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে । কামারের তৈরি এক টুকরো লোহার ফাল আর কাঠমিস্ত্রির হাতে তৈরি কাঠের লাঙল, জোয়াল, খিল, শক্ত দড়ি আর নিজেদের বাঁশের তৈরি মই ব্যবহার করে এক সময় জমি চাষাবাদ করতেন গ্রামঞ্চলের কৃষকরা। যা বর্তমানে খুব দেখা যায় না। বারহাট্টা উপজেলার সাহতা গ্রামের চাষি কালাম বলেন, কৃষিকাজে ব্যবহৃত এসব স্বল্পমূল্যের কৃষি উপকরণ এবং গরু দিয়ে হালচাষ করে এ অঞ্চলের মানুষ যুগের পর যুগ ধরে ফসল ফলিয়ে জীবিকা নির্বাহ করে আসছিলেন। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ রক্ষা হয়, অন্যদিকে কৃষকের অর্থ ব্যয় কম হয়। ফসলের পাশের কিংবা ঘাসপূর্ণ জমিতে হালচাষের সময় গরু যাতে কোনো খাদ্য খেতে না পারে, সেদিক লক্ষ্য রেখে পাট, বেত, বাঁশের কঞ্চি অথবা লতাজাতীয় এক ধরণের গাছ দিয়ে তৈরি গোমাই, তুরি (অনেকে ঠুসি নামে চেনেন) গরুর মুখে বেঁধে দেওয়া হয়। আর তাড়াতাড়ি হাল চালানোর জন্য ব্যবহার করেন বাঁশের বা শক্ত কোনো লাঠি দিয়ে তৈরি পাচুনি (লাঠি)। এটি খুব বেশি দিনের কথা নয়, কয়েক বছর আগে কথা। এসব গরু, লাঙ্গল-জোয়াল আর মই দিয়ে হরহামেশাই হাল চাষ করতে দেখা যেতো জেলার বিভিন্ন গ্রামের কৃষি জমিতে। চাষি নজরুল ইসলাম বলেন, অনেক চাষি নিজের জমিতে হালচাষ করার পাশাপাশি অন্যের জমি চাষিয়ে পারিশ্রমিক হিসেবে কিছু অর্থও উপার্জন করতেন। তারা হাজারো কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কখনো কখনো ফুরফুরে আনন্দে মনের সুখে ভাওয়াইয়া,পল্লিগীতি ও ভাটিয়ালী গান গেয়ে গেয়ে জমিতে চাষ দিতেন। এখন হাতে গোনা দু-একজন কৃষককে পাওয়া যায়। আর চাষ কাজের জন্য হালের গরু ছোট থাকাকালীন পোষ মানাতে বেশ কিছুদিন সময় লাগতো। ভোররাত থেকে শুরু করে প্রায় দুপুর পর্যন্ত জমিতে হালচাষ করতেন তারা। চাষিরা জমিতে হাল নিয়ে আসার আগে চিড়া-গুড় অথবা মুড়ি-মুড়কি দিয়ে হালকা জল খাবার খেয়ে নিতেন।

বর্ষাকালে কারো জমির চাষাবাদ পিছিয়ে গেলে সবার শেষে হাল চাষিরা নিজে থেকে হাল গরু নিয়ে এসে পিছিয়ে পড়া চাষিদের জমি চাষ দিতেন। হাল চাষিদের সঙ্গে আরো যোগ দিতেন ধানের রোপার চারা লাগার লোকজন। সকলের অংশ গ্রহণে উৎসবমুখর এই কাজটিকে বলা হতো-‘কৃষাণ’। কৃষ্যাণে অংশ নেওয়া কৃষাণদের জন্য জমিওয়ালা গেরস্থরা বড় বড় মোরগ, হাঁস কিংবা খাসি জবাই করে ভোজ করাতেন। কিন্তু আজকাল সময়ের আবর্তে  জেলা থেকে এসব গরুর হাল, কৃষি উপকরণ কাঠের লাঙ্গল, জোয়াল, বাঁশের মই হারিয়ে যেতে বসেছে এবং হাল-কৃষাণ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বিলুপ্তির কারণ, এ যুগে মানুষের অসীম চাহিদা আর অভাবময় জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া দিতে আবির্ভূত হয়েছে দামি দামি যান্ত্রিক হাল যেমন, কলের লাঙল, ট্রাক্টর। সঙ্গে এসেছে ফসলের বীজ বপন-রোপণ, ঝাড়াই-মাড়াই করার যন্ত্র। আর এসব যন্ত্র চালাতে মাত্র দু’একজন লোক প্রয়োজন। ফলে বিত্তবান কৃষকরা ওই যন্ত্র কিনে মজুরের ভূমিকায় কাজ করলেও গ্রামের অধিকাংশ মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত ও দিনমজুরের জীবন থেকে ঐ সব ঐতিহ্যময় স্মরণীয় দিন চিরতরে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আগামী প্রজন্ম হয়তো জানতেই পারবে না এভাবে অতীতে চাষ-কাজ করা  হতো।
ab.bg

Related Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *