বাগেরহাট প্রতিনিধি:
সিডর-২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ,৯০৮ প্রাণহানী’র ১৫ বছর,শেষ হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ, অপরিকল্পিত স্লুইজ গেইট ভোগাচ্ছে স্থানীয়দের
এক বা দুই নয়, প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় সিডরে একে একে ৯০৮ জন মানুষ মারা যায় উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটে। রাতেই লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূল। ভোরের আলো ফুটতে দৃশ্যমান হতে থাকে তান্ডবের চিত্র। বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয় পড়ে পুরো জেলা। স্বজনহারা ও আহতদের কান্নায় ভারি হয়ে উঠে বাগেরহাটের আকাশ-বাতাস।
সরকারি হিসেবে সিডরে বাগেরহাট জেলায় নিহত হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন ১১ হাজার ৪২৮ জন। সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয় ৬৩ হাজার ৬০০ বাড়িঘর। আংশিকভাবে বিধ্বস্ত বাড়িঘরের সংখ্যা ১ লাখ ৬ হাজার। সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয় পাকা ৫ কিলোমিটার সড়ক, কাঁচা সড়ক ধ্বংস হয় প্রায় ৫০ কিলোমিটার এলাকার। আর পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয় সাড়ে ১৬ কিলোমিটার বাঁধ। মারা যায় ১৭ হাজার ৪২৩টি গবাদি পশু। বিনষ্ট হয় ১২ হাজার হেক্টর ক্ষেতের ফসল ও ৮ হাজার ৮৮৯ হেক্টর চিংড়ি ঘের।
সিডরের সেই ভয়াবহতা আজও তাড়িত করে ফিরে উপকূলবাসীদের। ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখে আঁতকে উঠেন অনেকে।
২০০৭ সালে কাজের জন্য দুই বোনের সাথে চট্টগ্রামে ছিলেন শরণখোলার শফিকুল ইসলাম পঞ্চায়েত। বাড়িতে বাবা-মা, ছোট ভাই, দুই ভাগ্নি আর ভাগ্নে ছিল। ঝড়ের পরের দিন অনেক কষ্টে শরণখোলায় ফিরে আসেন তারা। বাড়িতে থাকা সাত জনের মধ্যে একমাত্র বেচে ছিলেন ছোট ভাই মোঃ সোহাগ, তাদের বাড়ি থেকেই মারা যায় ৬ জন। এছাড়া জলোচ্ছাসে ভেসে গেছে তার বংশের দুই বছরের শিশু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সের ২২ জন নারী-পুরুষ। স্বজন হারানোর কথা মনে উঠলে আজও থমকে যান তারা।
এই পরিবারের মধ্যে বেঁচে যাওয়া মোঃ সোহাগ বলেন, ২০০৭ সালে আমি ৩য় শ্রেণির শিক্ষার্থী। বৃষ্টিতে ভিজে সন্ধ্যার দিকে বাড়ি আসি। মা একটু রাগও করে। সন্ধ্যার পরেই শুরু হয় বাতাস। রাত আনুমানিক ৯ টার দিকে মানুষের ডাক-চিৎকারে আমরাও বাড়ি থেকে বের হই। প্রথমে পাশের বাড়ি আশ্রয় নিই। ঘরের মধ্যে পানি আসতে শুরু করলে আশ্রয়কেন্দ্রের উদ্দেশ্যে বের হই। অন্ধকার আর প্রতি মূহুর্তে পানি বাড়ছে। হঠাত পানির তোড়ে পরিবারের থেকে দলছুট হয়ে যাই। স্রোত আমাকে বড় একটি গাছের উপরে ছুড়ে মারে। আর এই গাছ ধরেই বেঁচে যাই আমি। সকালে পরিবারের কাউকে খুজে পাইনি। চার দিন পর মায়ের মরদেহ আর ১০ দিন পরে বাবার মরদেহ খুজে পাই। স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে বার বার বাকরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিলেন সোহাগ।
বাগেরহাট জেলার শরণখোলা উপজেলার বলেশ্বর নদী পাড়ের বগী এলাকায় দেখা যায়, এখনও সেখানে কয়েকটি ঝুপরি ঘর রয়েছে। এর মধ্যে একটি ঘরে থাকেন আশির্ধ্বো জয়নব বিবি। সিডরে হারিয়েছেন থাকার জায়গা ঘরটুকু। সন্তানেরা বাইরে থাকে। কোনো রকম মানুষের কাছে চেয়ে দিন কাটে তার। বাধের পাশে ঘরটুকু পেয়েছিলেন তাও যে কোনো সময় পড়ে যেতে পারে। হালকা বাতাস হলেও দুঃশ্চিন্তায় রাত জেগে বসে থাকতে হয় তাকে। এই নড়বড়ে ঘর-ই তার একমাত্র সম্বল।
গাবতলা গ্রামের বাহাদুর খান জানান, সিডরে তার এক বোন, চাচা এবং চাচীকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কয়েকদিন পর ধানক্ষেত থেকে তাদের মৃতদেহ উদ্ধার করে দাফন করেন।
স্বজন হারানো বেদনা ও আর্থিক ক্ষতি ভুলে উপকূলবাসীর একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়িবাঁধ। সিডরের ১৫ বছরেও শরণখোলাবাসীর প্রাণের দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মান শেষ হয়নি।
বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে সরকার ২০১৫ সালে সাড়ে তিনশ কোটি টাকা ব্যয়ে উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্প (সিইআইপি) নামে একটি প্রকল্পের অধীনে মোরেলগঞ্জ থেকে শরণখোলা উপজেলার বগী-গাবতলা পর্যন্ত ৬২ কিলোমিটার টেকসই বাঁধ নির্মান শুরু হয়। বেড়িবাঁধের প্রায় ৬০ কিলোমিটার কাজ সম্পন্ন হলেও অরক্ষিত রয়েগেছে সাউথখালী ইউনিয়নের গাবতলা আশার আলো মসজিদ থেকে বগী, তেরাবাকা-শরণখোলা পর্যন্ত দুই কিলোমিটার বাঁধ।
২০১৬ সালে ২৬ জানুয়ারি শুরু হয় কাজ। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা ছিল; কিন্তু ঠিকাদার পরবর্তী সময়ে আরো তিন দফা সময় বাড়িয়েছেন। সর্বশেষ বর্ধিত মেয়াদ অনুয়ায়ী, ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে বাঁধ হস্তান্তরের কথা রয়েছে।
সম্প্রতি উপকূলে দূর্যোগ না থাকলে বাঁধ ভেঙ্গে নদীগর্ভে চলে হচ্ছে। নদী শাসন ছাড়া শুধু বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করে ভাঙনের প্রতিকার মিলবে বলে দাবি স্থানীয়দের। এসব বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগও রয়েছে। এছাড়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মাণাধীন ৩৫/১ পোল্ডারের বেড়ি বাঁধে পর্যাপ্ত স্লুইসগেট নির্মাণ না করে অপরিকল্পিতভাবে ছোট করে অল্প সংখ স্লুইজ গেট নির্মাণের কারণে বৃষ্টি বা জোয়ারের পানি নিষ্কাশন হয় না ঠিকমত। ফলে দিনের পর দিন পানিবন্দী থাকতে হয় স্থানীয় বাসিন্দাদের। স্থানীয়রা জানান, একটু ভারি বৃষ্টি হলেই কয়েকদিন পানিবন্দী হয়ে পড়তে হয় তাদের। পানি নামার ব্যবস্থা না থাকায় গত ২৭ জুলাই বৃষ্টির পানিতে ৭ দিন পানিবন্দী ছিল উপজেলার কয়েক হাজার মানুষ। পানিতে নিমজ্জিত ছিল আমনের বীজতলা। একসপ্তাহ পরেও পানি না নামায়, বাঁধ কেটে দেয় ক্ষুব্ধ জনতা।
স্থানীয় সিদ্দিক ফকির নামের এক ব্যক্তি বলেন, সিডরের পর থেকে আমাদের একমাত্র দাবি ছিল টেকসই বেড়ি বাঁধ ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মান। কিন্তু ১৫ বছরেও আমাদের এখানে বেড়িবাঁধ নির্মান শেষ হয়নি। কোথায় যাব আমরা, প্রতিবছরই ঝড়-জলোচ্ছাসে আমাদের জান মালের ক্ষতি হয়।
চলতি বছরের ১১ মে দুপুরে শরণখোলা উপজেলার গাবতলা বাজার সংলগ্ন বেড়িবাঁধের মাঝে ১৫-২০ ফুট লম্বা ফাটল দেখা যায়। এর আগে, ফেটে যাওয়া এলাকায় বেড়িবাঁধের বাইরে থাকা গাবতলা গ্রামের ছফেদ খানের ১০ কাঠা জমি গাছপালাসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়।
ছফেদ খান বলেন, বেড়িবাঁধের বাইরে আমার এক বিঘা (৬৫ শতক) জমি ছিল। হঠাৎ করে ১০ কাঠা জমি ডেবে যায়। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে নদী গর্ভে বিলিন হয়ে যায় আমার জমি। বাকি জমিতেও ফাটল রয়েছে। যেকোন সময় নদীতে বিলিন হয়ে যেতে পারে। এভাবে বাপ-দাদার অনেক জমি হারিয়েছি আমরা।
নির্মানের বাঁধের মধ্যে মাটি না দিয়ে বালু দেওয়ায় এমন ফাটল ধরেছে বলে দাবি জন প্রতিনিধি ও এলাকাবাসীর।
সাউথখালী ইউনিয়ন ৭ ওয়ার্ড রিয়াদুল পঞ্চায়েত বলেন, আমাদের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল নদী শাষন করে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের। কিন্তু নদী শাসন না করেই বাঁধ নির্মাণ হওয়াতে ঝুকি হ্রাস পায়নি। নদী শাসন না করে নির্মিত বাঁধ বড় কোনো দূর্যোগে আবারও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা সংকটে ফেলবে বলে মনে করেন তিনি।
শরনখোলা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রায়হান উদ্দিন শান্ত বলেন, সিডর বিদ্ধস্ত মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বর্তমান সরকার ব্যাপক কাজ করেছে। কিন্তু টেকসই বেড়িবাঁধের নামে যে বাঁধ হয়েছে তা পরিকল্পিত ভাবে হয়নি। পর্যাপ্ত স্লুইজ গেট না থাকায় এই এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। সম্পন্ন হওয়া বাঁধে আরও স্লুইজ গেইট নির্মাণ এবং অসম্পূর্ণ যে বাঁধ রয়েছে সেই বাঁধ দ্রুত নির্মানের দাবি জানান তিনি।
উপকূলীয় বাঁধ উন্নয়ন প্রকল্পের (সিআইপি) নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের সময় নদীর গতি-প্রকৃতি যেভাবে ছিল, সেভাবে জেরিপ করে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু নদী গতিপথ পরিবর্তনের কারনে ভাঙন দেখা দিতে পারে। #
tn
Leave a Reply